মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শাহ আতিয়ুর রহমান ছিলেন অনন্য ব্যক্তিত্বে অসাধারণ
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারী ২০২৩, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন | মতামত

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ সভাপতি মরহুম শাহ আতিয়ুর রহমানের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী ২১ শে জানুয়ারি ২০২৩ এ বিনম্র শ্রদ্ধা। শাহ আতিয়ুর রহমান প্রাক্তন রাজনীতিবিদ,সমাজসেবক ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ছিলেন । তাঁর কর্মভাবনার মূল ছিল এদেশের দরিদ্র মানুষ। একাধারে তিনি ছিলেন কর্মী, সংগঠক এবং পরিকল্পক। অন্যদিকে নিজের পরিবার পরিজন এবং বন্ধুদের কাছে তিনি ছিলেন স্নেহ এবং ভালোবাসার আশ্রয়।দারিদ্র্যপীড়িত সহায়সম্বলহীন মানুষের জীবনের উন্নয়নকল্পে নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন তিনি ।
জন্ম ৫ মে, ১৯৩৯ খ্রি. এবং মৃতু্: ২১ জানুয়ারি, ২০১৮। তিনি ছিলেন একজন সদা হাস্যেজ্জল ও মিষ্টভাষী মানুষ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে ছিলেন মূর্তপ্রতীক। ন্যায়-নীতির মানদণ্ডে ছিলেন আপোষহীন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন একজন প্রতিবাদী ও সাহসী মানুষ। মহান মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গণে অকুতোভয় সৈনিকদের সাহস জোগাতে সফল সংগঠক হিসেবে যার ভূমিকা ছিলো অসামান্য। আমৃত্যু তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বুকে ধারণ করে গেছেন। মরহুমের পুত্র এস এম আসিফুর রহমান বাপ্পী বলেন আমার বাবার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে সকল চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। বাবার কর্মকাণ্ড তার ফেলে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ করার জন্য আমরা সকলে মিলে গড়ে তুলেছি এই ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মানুষের জন্য উন্নয়নের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করব। বাবার আদর্শ ধারণ করে আমি ও আমার পরিবার কাজ করে যাচ্ছি। আছি মানুষের পাশে এবং থাকবো।
এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নড়াইল জেলার লোহাগাড়া থানার লাহুড়িয়া ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি | সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও শিক্ষা জীবন শুরু হয় লাহুড়িয়ার হিন্দু পাড়া পাঠশালার ছাত্র হিসেবে। সেখানে বিভিন্ন হিন্দু ছেলে মেয়েদের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র মুসলমান ছাত্র। এ কারণে তিনি বাল্যকাল হতেই অসম্প্রদায়িক ছিলেন। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে লেখাপড়া করেন। তারপর লাহুড়িয়া হাফেজ আব্দুল করিম একাডেমিতে অষ্টম শ্রেণী শেষ করেন। এরপর যশোর জেলা স্কুুল থেকে ১৯৫৬ সালে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং যশোর ম. ম. কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করেন। ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী শেষ করেন। মরহুম শাহ আতিয়ুর রহমান একজন অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্র ছিলেন l
মরহুম শাহ আতিয়ুর রহমান বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং প্রচন্ড দেশপ্রেম নিয়ে ছাত্রজীবনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে যোগ দেন। ছাত্রলীগের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর দুই বার ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনে "সাধারণ সম্পাদক" পদে বিপুল ভোট এ নির্বাচিত হন। তৎকালীন উত্তাল সময়ে (১৯৬০-৬৩) পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব অত্যন্ত সফলতার সাথে পালন করেন। উল্লেখ্য উক্ত কমিটিতে সভাপতি ছিলেন বর্তমান স্পীকার শিরিন শারমিনের শ্রদ্ধেয় পিতা মরহুম রফিকুল্লাহ চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম শেখ ফজলুল হক মনি। রাজনীতি ছিল তার নেশা এবং পেশা। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করেন মরহুম শাহ আতিয়ুর রহমান। ১৯৭৫ পরবতী প্রেক্ষাপটে এবং আওয়ামী লীগ এর দুর্দিনে লোহাগাড়া তথা নড়াইল আওয়ামী লীগ কে পুনর্গঠন, মজবুত করে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ পরিণত করতে আমরণ শ্রম দিয়ে গেছেন এবর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ। ১৯৮৩-২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নড়াইল জেলা শাখার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা এবং ৬৯’র গণ অভ্যূত্থানে মরহুম শাহ আতিয়ুর রহমান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি । উল্লেখ্য বিষয় হলো-১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থাপতি, জাতির পিতা, বাঙালির মুক্তির মহা অগ্রদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর হত্যাকারীরা জাতীয় চার নেতা, তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রয়াত আব্দুস সামাদ আজাদ সহ প্রমুখ ব্যক্তিদের সাথে মরহুম শাহ আতিয়ুর রহমানকেও তুলে নিয়ে যায় বলে জানান তার পুত্র এসএম আসিফুর রহমান বাপ্পি ।তিনি আরো জানান আমার বাবার অপরাধ তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন। সুদীর্ঘ ৪৪ মাস বিনা অপরাধে কারা নির্যাতন ভোগ করেন তিনি । এ সময় তিনি রাজনৈতিক ভাবে নিগৃহীত হন। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর জেল হত্যাকান্ডের সময় তিনি জাতীয় চার নেতার সাথে একই কারাগারে অবরুদ্ধ ছিলেন। এখানে উল্লেখ প্রয়াত ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং আমার বাবা একই কারা কক্ষে ৩রা নভেম্বর জেল হত্যার দিন পর্যন্ত এক সাথে ছিলেন। এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তিনি জানান।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান আমেরিকান দূতাবাসে যোগদানের মধ্যে দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এসময় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সরবারহ করে বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন। নির্বাহী উপদেষ্টা হিসেবে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে মরহুম শাহ আতিয়ুর রহমানকে বাংলাদেশ সড়ক উন্নয়ন করপোরেশনের (বি আর টিসি ) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেন। ১৯৭৩-৭৫ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সহিত বাংলাদেশ সড়ক উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ৭৫’র কালো অধ্যায়ের পর থেকে ৯৬ পর্যন্ত তাকে অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হলে জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা মরহুম শাহ আতিয়ুর রহমানকে বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন ( বি এইচ বি এফ সি ) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেন। ১৯৯৮-২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে তিনি তার দায়িত্ব সমাপ্ত করেন।
মরহুম শাহ আতিয়ুর রহমান শুধু নিজেই একজন শিক্ষা অনুরাগী ছিলেন না তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও এই কাজে ভূমিকা পালন করেছেন। তার বড় ভাই প্রয়াত বিশিষ্ট শিল্পপতি এ এস এম আহাদ নিজ নামে নিজ গ্রামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার আলো ছড়ানো এবং শিক্ষাকে সবার মাঝে পৌঁছে দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এই পরিবারটি। গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানকল্পে গ্রহণ করতে হবে বাস্তবমুখী কর্মসূচি এগুলো নিয়ে ভাবতেন ও কাজ করতেন তিনি।
তার সন্তানেরা বলেন আমাদের বাবা একজন পরোপকার মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনায় ছিলো কিভাবে মানুষের উপকার করা যায়। সমাজে গরীব-নিপীড়িত মানুষকে নিয়ে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুর্দিনে তিনি নিবেদিত কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের পরীক্ষিত সৈনিকদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি এনজিও। যেখানে তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর (১৯৮৬-২০০৮) ধরে ৩,০০০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার পরিবারের পক্ষ থেকে আরও বলা হয় তৎকালীন সময়ে লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক ভিপি বাচ্চু, বর্তমান লোহাগাড়া আওয়ামীলীগ এর সভাপতি মুন্সী আলাউদ্দিন, তৎক্ষালীন লোহাগড়া ছাত্রলীগ এর সভাপতি সৈয়দ আকরাম হোসেন আঁখিদুল, জয়পুর ইউনিয়ন এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান আকতার, লাহুড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামি লীগ এর প্রাক্তন সভাপতি আব্দুস সালাম শিকদার ও গোলাম রসুল, শালনাগার আওয়ামী লীগ এর পরীক্ষিত সৈনিক আক্কাস এবং গোলাম সোহবান , কাশিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম মোস্ত,নড়াইল জেলা যুব লীগ এর আহবায়ক বাবুল সাহা সহ অগণিত আওয়ামী পরিবারের নির্যাতিত নেতা কর্মী ছিল তার সাথে। তিনি বলেন আমার বাবা দুর্দিনে সুদিনে এই সকল মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতেন। তার সেই পরামর্শগত শিক্ষা আমি ও আমার পরিবার লালন করে থাকি। তিনি আরো বলেন আমার পিতা নারী শিক্ষার বিস্তারে ও সমাজের শিক্ষার হার বৃদ্ধিকল্পে লাহুড়িয়া আজিজুর রহমান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয় ও শাহ আতিয়ুর রহমান গণগ্রন্থগারের প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । এছাড়া তিনি বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসা এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। সুপেয় পানির ব্যবস্থার জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বাড়িতে। এস এম আসিফুর রহমান বাপ্পি আরো বলেন নড়াইল এর খেটে খাওয়া মানুষ, নড়াইল আওয়ামী লীগ এর সকল নেতা কর্মী তথা এই জনপদের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের প্রতি তাঁর অকুন্ঠ ভালবাসা, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু প্রতি তার শ্রদ্ধা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা, দলের প্রতি তাঁর দায়িত্ব বোধ রেখে গেছেন আমার বাবা সবসময়। বাবার সেই শিক্ষা আমাকে সব সময় ভাবতে শেখায়, অনুপ্রাণিত করে, দেশপ্রেম এ উদ্বুদ্ধ করে l তিনি আরো বলেন এ শিক্ষাকে লালন করি বলে আমিও জাতীয় সংসদে মনোনয়ন প্রাপ্ত হয়েও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা ও দলের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করি এবং দলকে সংগঠিত করার জন্য স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছি। এস এম আসিফুর রহমান বাপ্পি বলেন আমার বাবা মরহুম শাহ আতিয়ুর রহমান এর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি তার এই মৃত্যুবার্ষিকীতে l মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন l আমীন l
ড. সৈয়দ নাজমুল হুদা
সাংগঠনিক সম্পাদক, শাহ আতিয়ুর রহমান ও ফরিদা রহমান মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন।