প্রকৃতির প্রতিশোধ

 প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ১২:৪০ অপরাহ্ন   |   মতামত

প্রকৃতির প্রতিশোধ


একসময় জলবায়ু পরিবর্তন ছিল দূর ভবিষ্যতের এক সম্ভাব্য সংকট। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু মানুষ সেসব কথা পাত্তা দেয়নি। এখন আর এটা ভবিষ্যতের ভয় নয়, বর্তমানের বাস্তবতা। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে প্রকৃতি যেন প্রতিশোধ নিচ্ছে। দুর্যোগের ধরন বদলে যাচ্ছে, তীব্রতা বাড়ছে, আর এর সরাসরি শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আমরা এখন বিশ্ব জুড়ে জলবায়ুর প্রতিশোধ দেখতে পাচ্ছি। গত এক মাসের জলবায়ু দুর্যোগের চিত্র যেন এক বৈশ্বিক হাহাকারের প্রতিফলন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া আর টেক্সাসে দাবদাহ সম্প্রতি বছরগুলিতে এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরাই কঠিন হয়ে পড়তে যাচ্ছে।  ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়ে ফেলা তাপমাত্রা শুধু মানুষ নয়, রাস্তাঘাট, গাছপালা, এমনকি বিদ্যুত্লাইনকেও বিকল করে দিতে দেখা গেছে। অন্যদিকে, ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে প্রায়শই ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে প্রবল বন্যা দেখা দিচ্ছে। ইতালির ভেনিস, ফ্রান্সের কিছু শহর আর জার্মানির নদীতীরবর্তী অঞ্চল পানির নিচে চলে যেতে দেখা যাচ্ছে। চীনে আকস্মিক বন্যা আর ভূমিধস জনজীবনকে অচল করে দিচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়ার দাবানলও নতুন এক রূপ নিচ্ছে। সেখানে আগুন নেভানোর আগেই আবার অন্য কোথাও দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করছে। গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর আবহাওয়া ব্যবস্থা এখন এতটাই অস্থির হয়ে গেছে যে, এক জায়গায় খরার সময় অন্য জায়গায় ভয়াবহ বর্ষণ হচ্ছে, যা স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে। বাংলাদেশের অবস্থাও ভালো নয়। তীব্র তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টিজনিত বন্যা এবং ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় দেখা যাচ্ছে। তাপপ্রবাহ এমন ছিল যে, দেশ জুড়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ করতে হয়েছে। শহরের রাস্তায় গরমে হাঁসফাঁস করা মানুষের ছবি আর গ্রামের মাঠে শুকিয়ে যাওয়া ফসল একই বাস্তবতা তুলে ধরে। গরমের তীব্রতায় বয়স্ক ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। যদিও বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় নতুন কিছু নয়, তবে সম্প্রতি উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। পটুয়াখালী, খুলনা, বরগুনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ফসলি জমি নষ্ট হয়ে গেছে। এই লবণাক্ততার কারণে ভবিষ্যতে কৃষি উত্পাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, যা খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলবে।

বন্যার প্রসঙ্গও কম ভয়াবহ নয়। জুনের শুরুতেই সিলেট অঞ্চলে যে বন্যা হয়েছে, তা আগের বছরগুলোর চেয়ে বেশি তীব্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, হিমালয়ের বরফ দ্রুত গলছে, ফলে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরে সিলেট, সুনামগঞ্জের মতো এলাকা বছরের প্রায় অর্ধেক সময় পানির নিচে থাকতে পারে।

তহলে ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিন আরো বড় দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হবে। দিন যত যাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এবং মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। কারণ বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। গ্রীষ্মের শেষে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খরার সম্ভাবনা প্রবল, যা দেশের ধান উত্পাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে শীত মৌসুমেও ভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। অনেক গবেষক বলছেন, এবারের শীত অস্বাভাবিকভাবে কম তীব্র হতে পারে, যা দেশের গম ও আলু চাষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

 এখন এসব সমস্যা মোকাবিলায় আমরা কি প্রস্তুত? এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের জলবায়ু মোকাবিলার অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের, কিন্তু এখনকার চ্যালেঞ্জ একেবারেই নতুন। শুধু বাঁধ বা আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করলেই হবে না, বরং জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। লবণাক্ততা সহনশীল ফসল, শহরে সবুজায়ন বাড়ানো, নদী ও খালের প্রবাহ ঠিক রাখা এবং নগর ব্যবস্থাপনায় জলবায়ুর উপযোগী পরিকল্পনা নিতে হবে। এমনকি সাধারণ মানুষেরও প্রস্তুতি নিতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগ দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্রান্তিকালে, আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে—প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে টিকে থাকার কৌশলই এখন সবচেয়ে বড় অস্ত্র। বস্তুত, জলবায়ু পরিবর্তন এখন শুধু তত্ত্ব নয়, বাস্তবতার নির্মম রূপ। প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, সময় খুব বেশি নেই। এখনই যদি আমরা যথাযথ পদক্ষেপ না নিই, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত্ ভয়াবহ হয়ে উঠবে। তাই, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আমাদের জলবায়ু-বান্ধব জীবনধারা গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রকৃতির প্রতিশোধের শিকার হতে না হয়।



মতামত এর আরও খবর: