ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন: আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

 প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ০৯:৫২ পূর্বাহ্ন   |   মতামত

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন: আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা
ড. মাহরুফ চৌধুরী : বাংলাদেশের জনপ্রশাসন এক গভীর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার বহন করে, যার শিকড় রয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায়। তখনকার সেই ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হয়েছিল মূলত জনগণের সেবার জন্য নয়, বরং তাদেরকে শাসন, শোষণ ও দমন করার জন্য। তাই উপর থেকে নিচে নির্দেশনামূলক ক্ষমতার প্রয়োগই ছিল এর বৈশিষ্ট্য। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রত্যাশা ছিল একটি গণমুখী, অংশগ্রহণমূলক ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার যেখানে জনগণ হবে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃত উৎস এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন হবে জনগণের সেবক। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেও প্রশাসনে আমলাতন্ত্র প্রায় অবিকৃতভাবেই সেই ঔপনিবেশিক ছাঁচে রয়ে গেছে। এখনো জনপ্রশাসনের ক্ষমতা রয়ে গেছে কেন্দ্রীভূত, জবাবদিহিতার কাঠামো দুর্বল, এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা অত্যন্ত সীমিত। ফলে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার আজও প্রশাসনিক অনুকম্পার মুখাপেক্ষী যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কখনোই কাম্য নয়। মার্কিন ঔপনিবেশিক সমাজতাত্ত্বিক ও প্রাচ্যবিদ রোনাল্ড ইন্ডেন এবং পরবর্তীকালে অ্যান্তোনিও গ্রামশি যেভাবে ‘হেজেমনিক ক্ষমতা’ ও ‘রাজনৈতিক সমাজ বনাম নাগরিক সমাজ’-এর মধ্যকার দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন, তা এই বাস্তবতায় গভীর অর্থবহ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র যখন আমলাতন্ত্রের হাতে অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন জনগণ হয়ে পড়ে প্রান্তিক। এ এক ধরণের আধুনিক উপনিবেশায়ন, যেখানে শাসক ও শাসিতের মাঝে তৈরি হয় অদৃশ্য বিভাজন রেখা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে স্পষ্ট হয় যে, উপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহনকারী জনপ্রশাসন কখনোই একটি গণতান্ত্রিক ও জনমুখী রাষ্ট্রের অনুকূলে কার্যকর হতে পারে না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের সময়, যেখানে প্রশাসনের প্রধান লক্ষ্য ছিল শাসকের ক্ষমতা সংরক্ষণ, শোষণের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ, এবং জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। ‘সরকারের সহায়ক জনগণের সেবক’ নয়, বরং ‘সরকারের প্রতিনিধি’ হিসেবেই আমলারা কাজ করত। জনগণকে তাদের অধিকারবোধহীন ‘শাসিত’ বলে গণ্য করা হতো। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর এই প্রশাসনিক কাঠামো প্রায় অপরিবর্তিতভাবে নবগঠিত পাকিস্তানে প্রচলিত হয়, এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পরেও সেই উপনিবেশিক আমলাতন্ত্রই নতুন রাষ্ট্রে অব্যাহত থাকে। স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল একটি জনগণের রাষ্ট্র, যেখানে জনপ্রশাসন হবে জনসেবার মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, প্রশাসনিক সংস্কার না করে পূর্বতন কাঠামোই অব্যাহত রাখার ফলে আমলাতন্ত্রের ভেতর জন্ম নেয় এক ধরনের ‘ক্ষমতার স্বাদ’ যা থেকে তারা আজও মুক্ত হয়নি। জনপ্রশাসন তত্ত্বে মার্ক্স ওয়েবার যে আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর ‘যৌক্তিক আইনি কর্তৃত্ব’ (রেশনাল-লিগাল অথোরিটি)–এর কথা বলেছিলেন, তার অন্যতম শর্ত ছিল জবাবদিহিতা, নিয়মতান্ত্রিকতা ও নিরপেক্ষতা। কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় তা পরিণত হয়েছে ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রভাব’ ও ‘রাজনৈতিক আনুগত্যে’ গড়া এক ক্ষমতাকেন্দ্রিক ব্যবস্থায়, যেখানে সরকারি কর্মকর্তারা প্রায়শই জনগণের সেবক না হয়ে প্রভু হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের এই অবিকৃত রূপই আজ প্রশাসনকে জনবিচ্ছিন্ন এবং অনেক ক্ষেত্রে জনবিরোধী একটি ব্যবস্থায় পরিণত করেছে। বাংলাদেশের প্রশাসনিক বাস্তবতায় আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা যে কীভাবে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তা এখন আর গোপন নয়, বরং নিত্যনতুন ঘটনাপ্রবাহে তা হয়ে উঠছে নগ্ন ও নির্লজ্জ। সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা হবেন জনগণের সেবক, সরকারের নির্দেশনায় তারা কাজ করবেন জনগণের কল্যাণে। কিন্তু বাস্তবে প্রজাতন্ত্রের এই কর্মচারীরাই বিভিন্ন সময় সরকারকে হুমকি প্রদর্শনের দুঃসাহস দেখায় যেন তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রকৃত মালিক। এই ক্ষমতার আস্ফালন শুধু সাংবিধানিক চেতনার বিরুদ্ধেই নয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিও এক ধরনের ব্যঙ্গ। আজ জনপ্রশাসন শুধুমাত্র নীতিপ্রণয়ন বাস্তবায়নের কারিগরি বাহিনী নয়, বরং জনপ্রশাসনের রাজনীতিকীকরণের ফলে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়াতেও তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের মধ্যকার ভূমিকার বিভাজন দুর্বল হয়ে পড়ায় জনপ্রশাসন ক্রমশ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও প্রভাব বিস্তার করছে। এর ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রান্তে সরে যাচ্ছেন এবং জনগণের কণ্ঠস্বর প্রশাসনিক ছাঁকনিতে আটকে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্কের মাঝে এখন আমলাতন্ত্র দাঁড়িয়ে গেছে এক ‘শক্তিশালী মধ্যস্বত্বভোগী’ হিসেবে। প্রশাসনের একদিকে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়াস চালায়, অপরদিকে আবার পরস্পরের স্বার্থে তারা ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভাগাভাগিতে প্রবৃত্ত হয় যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট মিখেলসের ‘অলিগার্কির আয়রন আইন’ (আইরন ল অব অলিগার্কি)-এর বাস্তব রূপায়ণ। এ ব্যবস্থায় শাসন চলে যায় একটি সীমিত অভিজাত শ্রেণির হাতে, যেখানে গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনমুখী আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়ায়। জনপ্রশাসনের দুর্বৃত্তায়ণের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসনের মারাত্মক ঘাটতি। প্রশাসন যখন নিজেকে জনগণের সামনে জবাবদিহির বাধ্যবাধকতার ঊর্ধ্বে মনে করে, তখন সেটি শুধু দায়িত্ব এড়িয়ে চলে না বরং এক ধরণের ক্ষমতার বিকারগ্রস্ততায় আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের জনপ্রশাসন আজ সেই চিত্রেরই প্রতীক হয়ে উঠেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই যে কোনো ব্যর্থতা বা অন্যায়ের জবাবদানে অনীহা প্রকাশ করেন, এবং প্রায়শই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় সেই জবাবদিহির শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত রাখেন। এই অব্যবস্থার ফলে প্রশাসনিক দক্ষতার জায়গায় দেখা দেয় কর্তৃত্ববাদ, এবং সেবার জায়গায় আসে শোষণ। ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় আনুগত্য, প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতি এবং দায়িত্বহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এখন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের এই চিত্র ক্রমাগত ক্ষুণ্ণ করছে জনগণের আস্থা, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এক ভয়াবহ সংকেত। জনসেবা যেখানে নাগরিক অধিকার, সেখানে তা হয়ে উঠেছে আমলাতান্ত্রিক অনুকম্পার বিষয়। উন্নয়ন প্রকল্পে স্বচ্ছতার অভাব শুধু আর্থিক অপচয়ের জন্ম দিচ্ছে না বরং তা সৃষ্টি করছে এক ভয়াবহ বৈষম্য। যেসব অঞ্চলে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রভাব নেই, সেখানে নাগরিকরা উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ বাস্তবতা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক ভারসাম্যহীনতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ‘নিরীক্ষা ও মূল্যায়নের তত্ত্ব’ (মনিটরিং এন্ড ইভালুয়েশন থিওরি) বলছে, স্বচ্ছতা ও নিয়মিত মূল্যায়ন ছাড়া কোনো রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি সফল হতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের প্রশাসনিক বাস্তবতায় এ দুটি বিষয়েরই চরম অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রসংস্কারের প্রেক্ষাপট শুধুমাত্র প্রশাসনিক পুনর্গঠন সময়ের দাবি নয়, এটি গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ছাত্র-জনতার গণআকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিক উত্তরাধিকারও বটে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালের গণআন্দোলন উভয়ের মধ্যেই ছিল একটি যৌথ স্বপ্ন তথা একটি জবাবদিহিমূলক, জনকেন্দ্রিক, এবং কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও বাংলাদেশ সেই কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রব্যবস্থা অর্জনে ব্যর্থ, যার অন্যতম কারণ হলো জনপ্রশাসনের সংস্কারে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নৈতিক দৃঢ় অবস্থান ও নীতিগত প্রয়াসের অভাব। রাষ্ট্রপরিচালনার চর্চায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর 'যুক্তিবাদী আমলাতন্ত্র' তত্ত্বের মাধ্যমে প্রশাসনের কাঠামোগত যুক্তি, নিয়মতান্ত্রিকতা এবং নিরপেক্ষতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। ফ্রেডরিক উইন্সলো টেলর তার ‘বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা’ (সায়েন্টিফিক ম্যানেজমেন্ট) তত্ত্বে দক্ষতা, সময়ব্যবস্থাপনা এবং কাজের ফলপ্রসূতা বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে ‘নব্য জন ব্যবস্থাপনা’ (নিউ পাবলিক ম্যানেজমেন্ট) তত্ত্বানুযায়ী নাগরিককে 'গ্রাহক' হিসেবে বিবেচনা করে প্রশাসনকে আরও দ্রুত, সাশ্রয়ী ও ফলভিত্তিক করার তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে এসব তাত্ত্বিক ধারা এখনো নীতির পর্যায়ে রয়ে গেছে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রশাসন থেকে তো বটে এবং রাজনৈতিক দলগুলো থেকেও দেখা যায় একধরনের উদাসীনতা। আমলাতন্ত্রের জড় কাঠামো ও ক্ষমতা ধরে রাখার প্রবণতা আধুনিকীকরণের প্রয়াসকে বাধাগ্রস্ত করছে। এর ফলে জনপ্রশাসন আজো অনেকাংশে আচরণগতভাবে ঔপনিবেশিক, কাঠামোগতভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং কার্যকরভাবে জনবিচ্ছিন্ন রয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কাঠামোতে আমূল সংস্কার অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী যেখানে প্রশাসনিক দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক সেবাদান ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিকে রাষ্ট্রগুলো এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে এখনো পুরনো আমলাতান্ত্রিক কাঠামো দেশে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন এক সুসংহত, দীর্ঘমেয়াদি এবং নীতিনির্ভর প্রশাসনিক সংস্কার। সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামোগত রূপান্তরের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক সেগুলো হল: প্রথমত, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা। যখন প্রশাসনিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে, তখন জনপ্রশাসন জনগণের নাগালের বাইরে চলে যায়। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ও তৃণমূল প্রশাসনকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে প্রশাসনকে জনগণের নিকটবর্তী করা সম্ভব। এতে শুধু সেবার মানই বাড়ে না, বরং প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা এবং সম্পৃক্ততাও বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, প্রশাসনের সর্বস্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। আমলাতন্ত্রের কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অডিট ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। এটি কাঠামো ও পদ্ধতিগতভাবে এমন হতে হবে যেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে সক্ষম হয়। তৃতীয়ত, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা না হলে প্রশাসনিক শুদ্ধাচার সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ই-গভর্ন্যান্স, ওপেন ডেটা পোর্টাল এবং অনলাইন ফিডব্যাক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রম জনসম্মুখে উন্মুক্ত করা গেলে, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার হ্রাস পেতে পারে। এক্ষেত্রে তথ্যাধিকার আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। চতুর্থত, জনপ্রশাসনে নৈতিকতা ও পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। কর্মকর্তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে মূল্যায়ন এবং মূল্যবোধভিত্তিক মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া একটি আধুনিক, মানবিক প্রশাসন কল্পনা করা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রলস যে ‘ন্যায়বিচারসুলভ রাষ্ট্র’-এর কথা বলেছেন, তা অর্জনের জন্য প্রশাসনকে হতে হবে ‘নৈতিকতার বাহক’, নিছক ‘শাসনের অস্ত্র’ নয়। আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে দীর্ঘদিন ধরে নিঃস্ব ও নিস্পেষিত হতে থাকা জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ হলো জনপ্রশাসনের কাঠামোগত পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক আমূল রূপান্তর। এ ব্যবস্থাকে আর উপনিবেশিক ধারার ‘শাসনযন্ত্র’ হিসেবে নয়, একটি ‘সেবামূলক রাষ্ট্রযন্ত্র’ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে যেখানে প্রশাসনের প্রত্যেকটি স্তর হবে গণতান্ত্রিক নীতিমালায় পরিচালিত এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। এই জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার যেখানে রাজনীতিকরা প্রশাসনকে ক্ষমতা সংরক্ষণের বাহন হিসেবে ব্যবহার না করে জনসেবার হাতিয়ার হিসেবে দেখতে শেখেন, অন্যদিকে তেমনি প্রয়োজন সুশীল সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ। জনমতের চাপ, গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং নাগরিক সচেতনতাই পারে প্রশাসনকে বাধ্য করতে প্রগতিশীল সংস্কারের পথে। পাশাপাশি গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ও অনুসন্ধানী ভূমিকা প্রশাসনিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অদক্ষতা জনসম্মুখে তুলে ধরে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে। আমরা চাইলে সত্যিকার অর্থেই একটি স্বচ্ছ, মানবিক, জবাবদিহিমূলক এবং কল্যাণমুখী জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে পারি যা জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। আর সেটি করতে হলে উপনিবেশিক উত্তরাধিকারকে পরিত্যাগ করে আমাদের নিজস্ব প্রেক্ষাপটে উপযোগী, ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক দর্শনের ভিত্তিতে একটি নতুন কাঠামো ও নীতিমালা তৈরি করতে হবে। একমাত্র তখনই রাষ্ট্রযন্ত্র প্রকৃত অর্থে জনগণের হয়ে উঠতে পারবে। * লিখেছেন: ড. মাহরুফ চৌধুরী, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।