নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করছে মাত্রাতিরিক্ত লবণ গ্রহণ!
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ০৯:২০ পূর্বাহ্ন | ভিন্ন খবর

মানবদেহের জন্য লবণ অপরিহার্য উপাদান হলেও; মাত্রাতিরিক্ত লবণকে নীরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, উচ্চমাত্রার লবণ গ্রহণের ফলে রক্তচাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে। পাশাপাশি লবণে থাকা সোডিয়াম হূদেরাগের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। এছাড়া অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ স্ট্রোক, অস্টিওপরোসিস, পাকস্থলীর ক্যানসার, কিডনিতে পাথর ও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগসহ নানা রোগ হতে পারে।
এছাড়া অতিরিক্ত লবণ গ্রহণে বিশ্বে প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, যার মধ্যে বাংলাদেশে মৃত্যু হয় ২৪ হাজার। এই ঝুঁকি হ্রাস করতে, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৈনিক পাঁচ গ্রাম বা এক চা-চামচের কম লবণ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, রান্নায় কম লবণের ব্যবহার, স্বাদ আনতে প্রাকৃতিক মসলার ব্যবহার, পাতে লবণ না খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
আগে খাদ্যে লবণের প্রধান উত্স ছিল বাড়িতে রান্নায় ব্যবহূত লবণ ও পাতে বাড়তি লবণ যোগ করা। সময়ের সঙ্গে নগরজীবনে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ বাইরে খাওয়া ও প্যাকেজিং বা প্রসেস ফুডে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে নগরজীবনের ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রেস্টুরেন্টে বা স্ট্রিড ফুডে। হোটেল-রেস্টুরেন্ট কিংবা স্ট্রিডফুড মুখরোচক করতে ব্যাপকভাবে লবণের ব্যবহার হয়ে থাকে, যা বর্তমানে লবণ গ্রহণের অন্যতম প্রধান উেস পরিণত হয়েছে। একজন মানুষের দিনে যেখানে পাঁচ গ্রাম লবণ গ্রহণ করার কথা, সেখানে তারা গ্রহণ করছে ৯ গ্রাম লবণ। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি লবণ গ্রহণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, হূদেরাগ, স্ট্রোক, অস্টিওপরোসিস, পাকস্থলীর ক্যানসার, কিডনিতে পাথর ও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগসহ মানুষ নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের কারণে মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে বাংলাদেশে এই মৃত্যু হয় ২৪ হাজার। এই ঝুঁকি হ্রাস করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৈনিক পাঁচ গ্রাম বা এক চা-চামচের কম লবণ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৯ গ্রাম লবণ গ্রহণ করে, যা সুপারিশকৃত মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে—শহর-গ্রাম, শিশু-কিশোর-প্রাপ্তবয়স্ক নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ নিয়মিতভাবে প্যাকেটকৃত খাবার গ্রহণ করে থাকে। স্বাদে নোনতা না হলেও এসব খাবারে উচ্চমাত্রায় লবণ থাকে, যা আমাদের দৈনন্দিন লবণ গ্রহণের মোট পরিমাণকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয় এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
গবেষণার তথ্য বলছে, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারে সর্বোচ্চ ৭৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণকে নিরাপদ মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে দেখা গেছে, বাজারে বহুলপ্রচলিত ৬১ শতাংশ বিস্কুট, চিপস, চানাচুর, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট সুপ, ঝালমুড়ি, আচার, চাটনি ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট খাবারে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি লবণ পাওয়া গেছে। আর ৩৪ শতাংশ খাবারে নিরাপদ মাত্রার দ্বিগুণ অর্থাত্ ১ দশমিক ৫ গ্রামের বেশি লবণ পাওয়া গেছে। এছাড়া, চানাচুর, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট সুপ ও ঝালমুড়ির কোনোটিতেই নির্ধারিত মাত্রার লবণ পাওয়া যায়নি, বরং এগুলোতে দ্বিগুণের বেশি লবণ রয়েছে। একইভাবে চাটনিতে ৮৩ শতাংশ, চিপসে ৬৩ শতাংশ এবং ডাল ও বুট ভাজার ৬০ শতাংশে দ্বিগুণ লবণ রয়েছে বলে গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষই এজাতীয় খাবার খেয়ে থাকে। অতিমাত্রায় লবণ গ্রহণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হূদেরাগ, স্ট্রোক ও কিডনি রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। আর এসব রোগ প্রতিরোধ করতে হলে প্রক্রিয়াজাত খাবারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে লবণের পরিমাণ নির্ধারণ করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের প্যাকেটে পুষ্টি সম্পর্কিত তথ্য যথাযথভাবে উল্লেখ করতে হবে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষক ডা. তামান্না আফরোজ বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিদিন পাঁচ গ্রাম লবণ গ্রহণের পরামর্শ দেয়। একজন সুস্থ মানুষের দিনে এক চা চামচের কম লবণ খাওয়া উচিত। না হলে উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, হার্টের জটিলতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যত সার্ভে হয়েছে, সবখানেই দেখা গেছে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে কমপক্ষে ১০ গ্রাম লবণ খায়। ছোটবেলায় আমরা প্রক্রিয়াজাত খাবারের মধ্যে শুধু চিপস আর চানাচুর খেতাম। এখন অনেক রকম পণ্য বাজারে পাওয়া যায় এবং সহজলভ্য। এখান থেকেও আমরা অনেকখানি লবণ গ্রহণ করি।’
গবেষকদের মতে, হূদেরাগ বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক রোগ। বিশ্বের প্রায় ৬২ কোটি মানুষ হূদেরাগে আক্রান্ত। সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতি দেড় সেকেন্ডে বিশ্বব্যাপী এক জন রোগীর মৃত্যু হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকে। এ রকম চলতে থাকলে ২০৩০ সালে মৃত্যুর হার বেড়ে বছরে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ মারা যাবে হূদেরাগের কারণে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘লবণ শুধু স্বাদের উপাদান নয়, অতিরিক্ত গ্রহণ করলে এটি হূদেরাগ, স্ট্রোক, কিডনি রোগসহ অসংক্রামক রোগের বড় ঝুঁকি তৈরি করে। তিনি বলেন, ‘লবণ ব্যবহার করলে সোডিয়াম থাকবেই। সেটা রান্না হোক বা অন্য খাবারেই হোক। আর এই সোডিয়াম—হূদেরাগ, পাকস্থলীর ক্যানসার সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে লবণে সোডিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের কথাও আমরা বলছি।’ তিনি জাতীয় পাঠ্যক্রমে লবণের ক্ষতিকর প্রভাব অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন, যাতে শিশু বয়স থেকেই স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের লাইন ডাইরেক্টর অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, ‘সুস্থ জীবন যাপনের জন্য অবশ্যই লবণের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেটা হতে হবে পরিমিত। গ্রহণের মাত্রা যেন পাঁচ গ্রামের বেশি না হয়।’ তিনি বলেন, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সরকার বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত কার্যপরিকল্পনা রয়েছে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে চলেছে।