ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে হতে পারে ভ্রমন পিপাসুদের স্বাপ্নিক ভ্রমন

 প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১০:১৭ পূর্বাহ্ন   |   লাইফস্টাইল

ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে হতে পারে ভ্রমন পিপাসুদের স্বাপ্নিক ভ্রমন

মোর্তুজা মিশু:


পৃথিবীতে বিলাসী নেশাগুলোর একটি হলো ভ্রমন করার নেশা। আর এই ভ্রমন এর কথা আসলেই বিখ্যাত ভ্রমনপিপাসু ইবনে বতুতা কে মনে হয়। তিনি ছিলেন পৃথিবীর প্রথম ভ্রমনপিপাসু যিনি আজও স্মরনীয়। আসলে ভ্রমন ব্যক্তিগত জীবনে এক অন্য রকম উন্মাদনা নিয়ে আসে সেই সাথে নিজের অভিজ্ঞতা কে সমৃদ্ধ করে। জেমস অগাস্টিন এর মতে, " পৃথিবী হলো একটা বই, অার যারা ভ্রমন করে না তারা সেই বইটি পড়তে পারে না"। তাইতো ভারতের চা বিক্রেতা দম্পতি বিজয়ন ও মোহনা চা বিক্রির টাকা দিয়ে ঘুরেচেন ২৩ টি দেশ এবং এভাবেই আগামী বছর গুলোতে নতুন নতুন দেশ ভ্রমন করেবেন তারা। গুস্তাভ ফ্লুবেয়ার এর ভাষায় " ভ্রমন মানুষ কে বিনয়ী করে তোলে। সে জানতে পারে দুনিয়ার তুলনায় সে কতোটা ক্ষুদ্র। আসলেই সত্যি তাই। ৭০০ কোটি মানুষের এই দুনিয়ায় আমরা কতোটা ক্ষুদ্র তা ভ্রমন না করলে বুঝতেই পারা যায় না। তাইতে রুচিশীলতার আরেক নাম ভ্রমন। আর তাই আজ লিখবো ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ নিয়ে যেটা হতে পারে ভ্রমণ বিলাসীদের স্বাপ্নিক ভ্রমন।




♥ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ পরিচিতি




ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ পৃথিবী সবচেয়ে দীর্ঘতম রেলপথ। রাজধানী মস্কোকে এই রেলপথ রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। রেলপথটি মস্কো থেকে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত হলেও কয়েকটি শাখা রেলপথের মাধ্যমে এটি মঙ্গোলিয়া, চীন এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গেও যুক্ত। ১৯১৬ সালে মস্কো থেকে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত পুরো রেলপথের কাজ সমাপ্ত হয়। এর কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৯১ সালে। সেই হিসাব অনুযায়ী রেলপথটি নির্মাণে প্রায় ২৫ বছর সময় লেগেছিল। তবে, এই রেলপথের সম্প্রসারণ এখনো অব্যাহত আছে। রুশ শাসক তৃতীয় আলেকজান্ডার এবং তার পুত্র জারেভিচ নিকোলাসের ঐকান্তিক ইচ্ছার ফসল এই রেলপথ। বাবার পথ ধরে জারেভিচ নিকোলাসও পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার জার হয়েছিলেন।


এছাড়াও মূল রেললাইনের কাজ সমাপ্ত হওয়ার প্রায় পাঁচ দশক পর ১৯৯১ সালে চতুর্থ একটি রেলপথ ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথে যুক্ত হয় যা ‘বৈকাল-আমুর মেইন লাইন’ নামে পরিচিত। এই লাইনটি বৈকাল হ্রদ থেকে কয়েকশ মাইল পশ্চিমে তাইশেত থেকে শুরু করে বৈকাল হ্রদ ও তার সর্ব উত্তরের অঞ্চলগুলোকে যুক্ত করেছে। এই রেলপথটি আমুর নদী পার হয়ে তাতার সমভূমিতে এসে শেষ হয়েছে।




ট্রান্স সাইবেরিয়ার রেলপথের আরেক নাম হতে পারে ইউরেশিয়ান পাইপলাইন




দীর্ঘতম এই রেলপথটি রাশিয়ার ইউরোপীয় এবং এশিয়ান অংশজুড়ে বিস্তৃত প্রায় কয়েকশ শহরকে সংযুক্ত করেছে। এই দীর্ঘ পথে কেউ ট্রেনে চড়ে বসলে তাকে আটটি টাইম জোন পাড়ি দিতে হবে। পুরো ভ্রমণ শেষ হতে বর্তমানে ৭ দিন সময় লাগে। মস্কো থেকে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত মূল পথটি ছাড়াও আরও দুটি রুট হলো মঙ্গোলিয়া হয়ে পেইচিং পর্যন্ত ট্রান্স-মঙ্গোলিয়ান রুট এবং মাঞ্চুরিয়া হয়ে পেইচিং পর্যন্ত ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়ান রুট।ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথের প্রধান লাইন থেকে ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়ান শাখা সাইবেরিয়ার সঙ্গে চীনের মাঞ্চুরিয়া ও পেইচিংকে যুক্ত করেছে। এই রুটটি চীন থেকে পুনরায় বের হয়ে ভ্লাদিভস্তকের উত্তরে আবার সাইবেরিয়ায় এসে সংযুক্ত হয়েছে। একদিক দিয়ে চীনে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে আবারও রাশিয়ায় ফিরে আসা সত্ত্বেও এই লাইনে কোনো গমন-নির্গমন যাত্রীসেবা নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই পথে চীন ও রাশিয়ার অনেক যাত্রী যাতায়াত করে থাকেন।ট্রান্স-মঙ্গোলিয়ান রেলপথটি বৈকাল হ্রদের পূর্ব উপকূল থেকে শুরু হয়ে মস্কোর সঙ্গে মঙ্গোলিয়া হয়ে চীনের পেইচিংকে যুক্ত করেছে। বর্তমানে পর্যটকদের কাছে এই রেলপথ দুরন্ত আকর্ষণের হলেও শুরু থেকে মালবাহী কার্গো আনা-নেওয়া করাই এই রেলপথের প্রধান উদ্দেশ্য। রাশিয়ার রপ্তানি খাতের প্রায় ৩০ শতাংশ পণ্য এ পথে পরিবহন করা হয়। প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ কার্গো কন্টেইনার আনা-নেওয়া করা হয় এই পথে।




ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথে নির্মানের কারণ




ট্রান্স সাইবেরিয়ান অঞ্চল শীতে আচ্ছাদিত। বেশিরভাগ সময়ই এখানে তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কারে নিছে। তাইতো বরপ বেষ্টিত এই অঞ্চলে বানিজ্যিক প্রসারে জলপথ এর পাশা পাশি রেলওয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তৎকালীন জার(জার-রুশ রাজাদের জার বলা হতো)। ১৮৯১ সালে রুশ মন্ত্রিসভায় সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয় ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ প্রকল্প।১৮৯১ সালের ১৯ মে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যায়। এই কাজ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয় অর্থমন্ত্রী স্যারগেই ইউটকে। জার নিকোলাস আলেক্সান্দ্রোভিচ উদ্বোধন করেন ‘দ্য গ্রেট সাইবেরিয়ান রেলওয়ে’র নির্মাণকাজ। তিনটি ধাপে এই নির্মাণকাজ ১৯১৬ সালে শেষ হয়। ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ নির্মাণের একেবারে শুরুতে ১৮৯১ সালে মাত্র ৯ হাজার ৬০০ শ্রমিককে নিয়ে কাজ শুরু হয়। কিন্তু ১৮৯৬ সালে এই সংখ্যাটি এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। তিন দ্বাপের এই এই রেলপথ তৈরি করতে সময় লাগে ২৫ বছর যা শেষ হয় ১৯১৬ সালে। পরীক্ষমূলকভাবে রেলপথটিতে যাত্রী পরিবহন শুরু হয় ১৯০৪ সালে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯১৬ সালে যাত্রা শুরু করে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ। রেললাইনটিতে বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু হয় ১৯২৯ সালে। ২০০২ সালের মধ্যে পুরো রেলপথই বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আসে।




কেমন হতে পারে আপনার ভ্রমন?


ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথে যাত্রীবাহী একটি ট্রেনের প্রথম শ্রেণির টিকিটের মূল্য ৫১১ পাউন্ড, দ্বিতীয় শ্রেণির ২৬১ পাউন্ড এবং তৃতীয় শ্রেণির টিকিট ১১৪ পাউন্ড। বর্তমানে বেশ কয়েকটি যাত্রীবাহী ট্রেন এই লাইনে চলাচল করে। কিছু ট্রেন আছে যার মধ্যে লাইব্রেরি, জিমনেসিয়াম, গ্রান্ড পিয়ানো, মার্বেল বাথরুম এবং মনোরম রেস্তোরাঁও রয়েছে। বছরের যে কোনো সময় এই রেলপথে ভ্রমণ করা যায়। শীতকালে এই রেলপথের গড় তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে, ট্রেনের তাপমাত্রা থাকে নিয়ন্ত্রিত। কাচের জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যায় কেবল বরফের রাজ্য। তবে গ্রীষ্মকাল, বিশেষ করে মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথে ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময়। এ-সময় আবহাওয়া বেশ ভালো ও মনোমুগ্ধকর থাকে। এই রেলপথ যারা ভ্রমণ করেছেন বৈকাল হ্রদের আড়াইশ কিলোমিটার অংশ পাড়ি দেওয়ার স্মৃতি তারা কখনোই ভুলতে পারবেন না। রাশিয়ার প্রাকৃতি সৌন্দর্য বিশেষ করে ছবির মতো গ্রাম রাশি রাশি দেবদারু ও পাইন গাছের সারি সেই সাথে বালুময় গোভি মরুভূমি ও চীনের মহাপ্রাচীর। ভ্রমনকালে রাশিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া ও করিয়ান কয়েক শত শহর সত্যি এই ভ্রমন কে বিশেষ মাত্রা দিবে। বাংলাদেশ থেকে যারা এই রেলপথে ভ্রমণ করতে যান তারা সাধারণত মস্কো থেকে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত অংশটি ভ্রমণ করে থাকেন। কারণ চীনা সরকার রাশিয়া এবং কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের নাগরিক ছাড়া এই পথে অন্যদের অনুপ্রবেশে বাধা দেয়।




পাঠকদের উদ্দেশ্যে, ভ্রমন করুন, নিজেকে জানুন, জানতে শিখুন। এই লিখাটি পড়ে চোখ বন্ধকরে ভাবুন হয়তো কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবেন আপনার স্বাপ্নিক ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ ভ্রমনকে। পরিশেষে ইবনে বতুতার ভ্রমন নিয়ে একটি বাস্তবিক উক্তি দিয়ে শেষ করবো। " ভ্রমন প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দিবে তারপর তোমাকে গল্পবলতে বাধ্য করবে"।




(মোর্তুজা মিশু, ব্যাংকার)



লাইফস্টাইল এর আরও খবর: