গৌরীপুর মহিলা ডিগ্রী (অনার্স) কলেজে অধ্যক্ষের চেয়ার ছাড়ছেন না অধ্যক্ষ রুহুল আমিন
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২২, ১২:৫১ পূর্বাহ্ন | সারাদেশ
শামীম খান (গৌরীপুর , ময়মনসিংহ) :
ময়মনসিংহের গৌরীপুর মহিলা ডিগ্রী (অনার্স) কলেজে চাকুরির মেয়াদ শেষ হলেও অধ্যক্ষের চেয়ার ছাড়ছেন না উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি অধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অফিস আদেশ গোপন করে বেতন উত্তোলন, কলেজে কর্মচারী নিয়োগ, একাধিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণসহ রয়েছে তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ।
এছাড়াও ৩১ মে অবসরে গিয়েও কলেজের কাগজপত্র ও ফাইল কেবিনেটের চাবি হস্তান্তর করেননি প্রধান অফিস সহকারী মো. শহীদুল্লাহ হুমায়ুন।
জানা যায়, কলেজের অধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন এর চাকুরীর মেয়াদ ২০২১সনের ১৫ মে শেষ হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার ১বছর ৪মাস ১৬দিন পর অবশেষে অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদা ইয়াসমিনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিলেও চেয়ার ও দাপ্তরিক দায়িত্ব হস্তান্তর করেননি এ অধ্যক্ষ। রোববার চেয়ার দখলকে কেন্দ্র করে অধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের মাঝে বাক-বিতন্ডা হয়েছে। এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী এমনকি স্থানীয়দের মধ্যে।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহমুদা ইয়াসমিন বলেন, অধ্যক্ষের চেয়ারের পাশে আমার জন্য একটি চেয়ার শিক্ষক ও কর্মচারীদের উপস্থিতে বসানো হয়। রোববার এটা দেখে স্যার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আরও জানান, আমাকে কোনো ফাইল-কেবিনেটের চাবি বা কাগজপত্র ঝুবিয়ে দেয়া হয়নি। অর্থনৈতিক দায়িত্বও বুঝে পাইনি। সোমবার পরীক্ষার্থীদের নানা সমস্যা নিয়ে আসলেও সমাধান করতে পারছি না।
এ প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন সাংবাদিকদের জানান, গভর্ণিং বডি আমাকে ২বছরের জন্য অধ্যক্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন। অনুমোদনের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে ২০২১সনের ৬ মে আবেদন করেছি। এ বিষয়ে হ্যাঁ-না কিছু জানানো হয়নি। তবে ১ অক্টোবর থেকে মাহমুদা ইয়াসমিনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমি এখন ছুটিতে আছি, ডিজির সিদ্ধান্ত পেলে সপদে (অধ্যক্ষ) ফিরে আসব।
পদ ছাড়লেও চেয়ার ছাড়ছেন না এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসলে বিষয়টা এমন না! আমি কলেজে আসি, কলেজে যারা আছেন তাদের দেখাশোনা করি, পরামর্শ দেই, খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য আসি।
সোমবার কলেজে যাওয়ার পর একাধিক শিক্ষক সাংবাদিকদেরকে জানান, কলেজ নিবন্ধন না থাকায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের রাইসুল ইসলাম ও সমাজকর্ম বিভাগের জান্নাতুল হাওয়ার ইন্টারভিও নেয়নি নিয়োগ বোর্ড। তারপরেও কলেজের অধ্যক্ষ নিয়ম বর্হিভূর্তভাবে এ দু’জনকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দিয়েছেন। কলেজ ফা- থেকে প্রতি মাসে দু’জনকে দেয়া হচ্ছে ২৬হাজার টাকা। কলেজে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে ৭বছর যাবত নিয়োজিত আছেন শামীমা আক্তার। কলেজের অফিস সহকারী মো. শহীদুল্লাহ হুমায়ুন এ বছরের ৩১ মে অবসরে যান। কলেজে যখন অধ্যক্ষ নিয়ে দ্বন্দ্ব সেই সময়ে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই সেই পদে কিভাবে শামীমা আক্তারকে নিয়োগ ও তার বেতন-ভাতা এমপিওভূক্ত করে দেয়া হয়েছে- এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা! এছাড়াও মেয়াদ উর্ত্তীণ এ অধ্যক্ষের সময়কালে নিয়োগ পাওয়া ল্যাব সহকারী পদে ৩জনের এমপিও এখনো চুড়ান্ত হয়নি- এ নিয়োগ নিয়েও রয়েছে শংকা। এছাড়াও কলেজের গভর্ণিং বডির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মো. বদর উদ্দিন খান পাঠানের দায়িত্বকালীন সময়ে বন্ধ করে দেয়ার পরেও অনার্স শাখার সেমিনার ফিস, কলেজ ফান্ডের নির্ধারিত বেতনের চেয়ে বর্ধিত বেতনসহ নানাখাতে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। কথিত আছে, কলেজের এসব আর্থিক কেলেঙ্কারী বন্ধ করার কারণে স্বনামধন্য এ শিক্ষককে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে প্রধান অফিস সহকারী মো. শহীদুল্লাহ হুমায়ুন জানান, দু’জন প্রভাষকের কলেজের নিবন্ধন নেই এটা সত্য। তাদের মধ্যে জান্নাতুল হাওয়াকে খ-কালীন আর দু’বছরের মধ্যে কলেজ নিবন্ধন করবেন এই শর্তে রাইসুল ইসলামকে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে নিয়োগ বোর্ড তাদের নিয়োগ দেননি। অফিস সহকারী শামীমা আক্তারকে সমন্বয় করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, আমি ৩১ মে অবসরে যাওয়ার পর চাবি অফিস সহকারী মো. রেজাউল করিমের নিকট বুঝিয়ে দিয়েছি। রেজাউল করিম জানান, অফিসের ফাইলপত্র ও চাবি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর হয়নি, তিনি শুধু আমার নিকট রেখে গেছেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহমুদা ইয়াসমিন জানান, এসব অভিযোগ শোনেছি। আমি দায়িত্বই পুরোপুরি বুঝে পাইনি, আপনাকে কী বলবো! এ প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিনকে মুঠোফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানান, চাকুরীবিধি লঙ্ঘন করে একদিনও দায়িত্ব পালন করা উচিত নয়, কেননা এ সময়ের মধ্যে তিনি যা করবেন তা অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ২৭অক্টোবর অফিস আদেশে উল্লেখ করে ৬০বছর পূর্ণ হওয়ার পর তিনি আর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। পরবর্তীতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অনুমোদন হলে আবারও দায়িত্বভার গ্রহণ করতে পারবেন। এ দপ্তরের সহকারী পরিচালক (কলেজ-৩) তপন কুমার দাস জানান, সাবেক অধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন এর চাকুরীর মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন এখন পর্যন্ত মঞ্জুর হয়নি।
কলেজের গভর্ণিং বডির সভাপতি ম. নূরুল ইসলাম জানান, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের পত্রের বিষয়টি এক বছর পেরিয়ে গেলেও অধ্যক্ষ আমাদেরকে (গভর্নিং বডি) আগে অবহিত করেন নাই। বিশ^বিদ্যালয় থেকে জানানোর পর গভর্নিং বডির সভার সিদ্ধান্তক্রমে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে মাহমুদা ইয়াসমিনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সাবেক অধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন বোর্ডের বা বিশ^বিদ্যালয় থেকে মেয়াদ বাড়াতে পারলে স্বপদে বহাল হবেন।
তিনি আরও জানান, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১-এর ১১.১১ অনুযায়ী ও জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ শিক্ষকদের চাকুরীর শর্তাবলী রেগুলেশন (সংশোধিত) ২০১৯ এর ১৫নং বিধানমতে ২০২১সনের ২ মে তারিখে ২৫হাজার টাকা বেতন নির্ধারণ করে ২বছরের জন্য মো. রুহুল আমিনকে অধ্যক্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়। এ নিয়োগের প্রেক্ষিতে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে চাকুরীর মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেন এ অধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন।
অপরদিকে এইচএসসির ৩৭৩জন পরীক্ষার্থীর টাকা কর্তনবিহীন ফেরতের দাবিতে ২০২১সনের ১৬জুন অবস্থান কর্মসূচী, বিক্ষোভ ও স্মারকলিপিসহ নানা আন্দোলন করতে হয়। এ সময় কলেজের সকল দুর্নীতি বন্ধের তারা দাবি জানান। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, দিচ্ছে ৪৮০টাকা আর স্বাক্ষর নিচ্ছেন ১হাজার ৬৫টাকার কলামে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান লিটা সে সময় সাংবাদিকদের জানান, স্বাক্ষর দিতে কেউ অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তাদের ধমক ও হুমকি দিয়ে স্বাক্ষর নেয়া হচ্ছে। ওই সময় ইউএনও হাসান মারুফ জানান, কলেজের অধ্যক্ষ তাকে জানিয়েছেন এ ফা-ের টাকা করোনাকালীন সময়ে অন্যখাতে খরচ হয়ে গেছে। আন্দোলকারীরা শিক্ষার্থীরা স্মারকলিপিতে সে সময় উল্লেখ করেন দুই বছর অধ্যয়নকালে তাদের নিকট থেকে নানা অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ নেয়া হয়েছে। কম্পিউটার ল্যাব, লাইব্রেরী ফি, বার্ষিক ক্রীড়া ফি, মিলাদ ও পূজা ফিসহ নানা চাঁদা। এসব খাতে বছরের পর বছর চাঁদা দিয়েও তারা কোন সেবা পায়নি।
এ দিকে গৌরীপুর মহিলা ডিগ্রী (অনার্স) কলেজে পাঠাগারের অর্থে নয়-ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। এ কলেজে ১হাজার ৭০৯জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। কলেজের হিসাব রক্ষক আশিকুর রহমান খান পাঠান জানান, প্রতিবছর প্রত্যেক ছাত্রীর নিকট থেকে পাঠাগারের নামে ১শ টাকা করে আদায় করা হয়। এ হিসাব অনুযায়ী বছরে পাঠাগার খাতে আসে ১লাখ ৭০হাজার ৬শ টাকা। তবে এ কলেজের প্রভাষক (গ্রন্থাগার) মো. কামাল হোসেন জানান, তিনি সাত বছরেও পাঠাগারের কোনো বরাদ্দ পাননি। নিয়মিত কোনো পত্রিকাও রাখা হয়না বা বই ক্রয় সংক্রান্ত কোনো তথ্যও তার জানা নেই।

