ইসলামিক স্কলার প্রিন্সিপাল মাওলানা রশীদ আহমদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলেন সন্তান এম. শাহাদাত হোসাইন তসলিম
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৪, ০৭:০৭ অপরাহ্ন | শোক ও মৃত্যুবার্ষিকী
আমার মরহুম আব্বা প্রিন্সিপাল মাওলানা রশীদ আহমদ ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ মহান রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। তিনি একজন বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ছিলেন। একাধারে শিক্ষক, বহু গ্রন্হ প্রনেতা, সমাজ সেবক, পরোপকারী ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন আমার প্রিয় পিতা। বিশেষ করে যে কোন ব্যক্তি অসুস্হ হয়েছে শুনলেই তিনি ছুটে যেতেন এবং তাকে হাসপালে নিয়ে যেতেন। গরীব লোকদের চিকিৎসার ব্যবস্হা করতেন। কুমিল্লায় তসলিম মেডিক্যাল হল নামে আমাদের একটি ফার্মেসী ছিল। আমার জন্মের পর সম্ভবত আব্বা ফার্মেসীটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সকল গরীবদের জন্য আব্বার ফার্মেসী অবারিত ছিল। সে সময়ে কুমিল্লার বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন ডা. হেদায়েতুল্লাহ। তিনি মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং আব্বার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বহু গরীব মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্হা করেছিলেন ওনারা দুজন মিলে। আব্বা অনেক জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
আব্বা ঢাকার বড় কাটারা ও ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন। তিনি মুন্সীগন্জের সিরাজদী খান মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্বও পালন করেছিলেন কিছু সময়। তিনি খুব মেধাবী ও আধুনিক মানসিকতার ইসলামিক স্কলার ছিলেন। তিনি ছিলেন আধুনিক, বিজ্ঞান মনস্ক, কোরআন-হাদিস বিষয়ে প্রাজ্ঞ ও শিরক বিরোধি ব্যক্তিত্ব। আব্বা ঢাকার বড় কাটারা ও ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু শিক্ষকতাকে তিনি পেশা হিসাবে নেন নাই। তিনি ব্যবসায়ি ছিলেন। যেহেতু তিনি নিজে লেখালেখি করতেন, তাই প্রকাশনার ব্যবসা ছিল আব্বার পেশা। একাধারে তিনি লেখক ও প্রকাশনা ব্যবসায়ি ছিলেন। আমাদের বই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল। ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেইটের পাশে এক সময় ঢাকার বিখ্যাত লাইব্রেরী গুলির বিশাল মার্কেট ছিল। এখানে আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল “ ফোরকানিয়া লাইব্রেরী”। পরে সরকার মসজিদ সম্প্রসারনের জন্য এই মার্কেট ভেঙ্গে ফেল্লে আব্বার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি ঢাকার বাংলা বাজারে স্হানান্তর করা হয়। সেখানে “ফোরকানিয়া লাইব্রেরী” ও “ তওহিদ পাবলিকেশন্স” নামে দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান করেন তিনি। শিক্ষক হয়েও আব্বা ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করা পছন্দ করতেন তিনি। কোরআন-হাদিস, ও ইসলামিক বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারি ছাড়াও তিনি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদি সকল বিষয়ে অনেক জ্ঞানী ছিলেন। তিনি একজন সুবক্তাও ছিলেন। তার লেখা “দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম” বইটি বর্তমান সময়ের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বহু গ্রন্হ লিখেছেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে ইসলামিক অনুষ্ঠান করতেন।
আমার জীবনের যা কিছু ভালো তার সব আব্বার থেকে শিখেছি। তিনি ছিলেন একজন পিতা, একজন শিক্ষক, একজন বন্ধু। আমার আব্বা আমার পরম বন্ধুও ছিলেন। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতাম, তর্ক করতাম। তিনি আমাকে শুনতেন, আমি ওনাকে শুনতাম। তিনি আমাকে অনেক বেশী স্নেহ করতেন, আমাকে অনেক বেশী টাকা দিতেন, যা চাইতাম তিনি না করতেন না। আমার প্রতি তার একধরনের স্নেহের অন্ধত্ব ছিল। তিনি জীবনে কখনো আমাকে সামান্য আঘাতও করেন নাই। তবে আমি মনে মনে ওনাকে ভয় পেতাম ও সমীহ করতাম।
আব্বা খুব পরিচ্ছন্ন ও গুছানো ছিলেন। তিনি মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। আতিথেয়তা করা আব্বার একটি বড় গুন ছিল। তিনি বাংলা ও ইংরেজীতেও পারদর্শী ছিলেন। আমাকে আরবী বাংলা ও ইংরেজী পড়াতেন মাঝে মাঝে। একজন লোক কিভাবে এত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হন, তা আমি ভেবে অবাক হই। আব্বা ছিলেন মানবিক মানুষ। তিনি আমার স্বপ্নের মহাপুরুষ। আকষ্মিকভাবে হঠাৎ করে তিনি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। তিনি কারো সেবা গ্রহন করতে চাইতেন না। বার্ধক্যে তিনি কারো বোঝা হতে চান নি। হয়তো মহান আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরন করেছেন, তাই সুস্হ সবল অবস্হায় তিনি ইন্তেকাল করে মহান আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। সেদিন ইউনাইটেড হাসপাতাল আব্বার ভুল চিকিৎসা করেছিল। তাই আব্বার ইন্তেকালের সময়ে সমবেত আমার বন্ধুরা হাসপাতাল ভাংগচুর ও চিকিৎসককে হামলার একটি চেষ্টা করেছিল। আমিও ক্ষুব্ধ ছিলাম। কিন্তু আমার সকল বন্ধুদেরকে আমি নিবৃত্ত করে বলেছিলাম যে, আজকে ইউনাইটেড হাসপাতাল ও এর ডাক্তারকে আমরা মাফ করে দিলাম, যেন এই মাফ করার বিনিময় আল্লাহ আমার আব্বাকে জান্নাত দান করেন। সেই থেকে ইউনাইটেড হাসপাতাল আমার কাছে অপ্রিয়।
তিনি ইসলাম ও মানবতার সেবায় সারা জীবন কাজ করেছেন, বহু দান খয়রাত করেছেন, বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, অসুস্হ মানুষের সেবা করেছেন, সারাজীবন শিরক বিরোধী ছিলেন, শিক্ষা প্রসারে বিশেষ অবদান রেখেছেন, মহান আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি পরম দয়ালু ছিলেন। এই সকল কিছুর উসিলায় মহান আল্লাহ তাকে রহমতের চাদরে ঢেকে রাখুন। আমি ২০১৭ সাল থেকে সম্মানিত হজযাত্রীদের অতি নগন্য খাদেম হিসাবে কাজ করি। হজযাত্রীদের কল্যানে যা যা করেছি বা করার চেষ্টা করেছি, তার সামান্যও যদি মহান আল্লাহ কবুল করেন, তাহলে তার উসিলায় তিনি যেন আমার প্রিয় আব্বাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন। মহান আল্লাহ আমাদের সকলের পিতাগণকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন।
দেশবরেণ্য এই আলেমকে কিংসনিউজ পরিবার গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে।