অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে সিরিয়া
প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৫, ১১:০১ পূর্বাহ্ন | আন্তর্জাতিক

বাশার আল আসাদের পতনের পর সিরিয়ায় বাথ পার্টির ৬১ বছরের শাসনের অবসান হয়। সেই সঙ্গে অবসান হয় আসাদ পরিবারের ৪১ বছরের শাসনের। ২০০০ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন বাশার আল আসাদ। কিন্তু জল ঘোলা হতে শুরু করে ২০১১ সালে। আরব বসন্তের হাওয়ায় উত্তাল হয়ে ওঠে মরুদেশটি। আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে—একনায়ক হঠাও, গণতন্ত্র ফেরাও স্লোগানে। শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ।
গত বছরের ডিসেম্বর সেই গৃহযুদ্ধের অবসান হয়েছে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে দেশটিতে। জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। ইতিমধ্যেই সেই আগুনে প্রাণ দিতে হয়েছে ১ হাজারেরও বেশি মানুষকে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির ভবিষ্যত্ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এমনকি দেশটিতে চরমপন্থা বাড়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রক্তক্ষয়ী সংঘাতে প্রতিশোধমূলক হত্যার শিকার হচ্ছে আলাউইত নামে এক সংখ্যালঘু শ্রেণি। এদের বাস মূলত সিরিয়ার উপকূলবর্তী এলাকা লাটাকিয়া এবং টারটসে। এটি সাবেক প্রেসিডেন্ট আসাদের সম্প্রদায়। পরিচয়পত্র দেখে বেছে বেছে খুন করা হচ্ছে এই সম্প্রদায়কে। যেসব গ্রামে আলাউইতদের বাস, সেখানে দেহ স্তূপাকার হয়ে পড়ে আছে। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ শিয়াপন্থি আলাউইত। আসাদের আমলে প্রশাসন এবং সামরিক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে ঠাঁই পান আলাউইতরা। এই পক্ষপাত সহ্য হয়নি বর্তমানে ক্ষমতাসীন সুন্নি জনগোষ্ঠীর।আসাদ না থাকলেও তার অনুসারীরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সংঘাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে সাধারণ নাগরিকদের। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, গত শুক্রবার ও শনিবার পশ্চিম উপকূলে আলাউইত সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করে চালানো নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে ৮৩০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। প্রাণ গেছে নিরাপত্তা বাহিনীর ১২৫ জন এবং আসাদবাহিনীর ১৪৮ জনের। তিন দিনে প্রাণ গেছে প্রায় দেড় হাজার মানুষের। দেশটির কোথাও পানি নেই, কোথাও বিদ্যুত্-সংযোগ বিচ্ছিন্ন। বেশির ভাগ মানুষই লুকিয়ে আছেন বাড়িতে। রাস্তায় বন্দুকধারীদের আনাগোনা। আলাউইত অধ্যুষিত শহরগুলোতেও নৃশংস হামলা চালাচ্ছে। রাস্তা, বাড়ির আঙিনা ও ছাদে পরিত্যক্ত অবস্থায় অগণিত লাশ দেখা গেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি একেবারেই অগ্নিগর্ভ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে নতুন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে আশঙ্কা। অনেকে সাম্প্রতিক অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী করেন অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল শারার নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তকে। তিনি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া সিরিয়ার সেনাবাহিনী, পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী সব বাহিনী ভেঙে দিয়েছেন। এর ফলে হাজার হাজার কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন ও তাদের ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত হয়ে গেছে। হাজার হাজার সরকারি কর্মকর্তাও চাকরিচ্যুত হয়েছেন। সিরিয়ার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে ও তাদের একটা বড় অংশের চাকরি নেই। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ভেতর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়াকে ‘স্বাভাবিক’ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিরিয়াকে এখন নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে প্রথম পদক্ষেপ হবে বিদেশি যোদ্ধাদের বের করা ও এমন একটি সংবিধান প্রণয়ন করা, যার মাধ্যমে ধর্ম বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব সিরিয়ানের অধিকার সুরক্ষিত হবে। তবে এসব পরিস্থিতির বিপরীতে গিয়ে সবচেয়ে খারাপ যেটা হতে পারে, সেটা হলো আরব বসন্তের পর অন্য দেশগুলোর মতোই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া।
কোনো বিকল্প ছাড়াই লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর বিদেশি হস্তক্ষেপ দুটি দেশেই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির কারণ হয়েছিল। সমালোচকদের মতে, স্বৈরাচারী শাসকদের পতনের ফলে তৈরি হওয়া শূন্যতা পূরণ হয়েছিল লুটপাট, প্রতিশোধ, ক্ষমতার দখল এবং গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে। এমন প্রেক্ষাপটে সিরিয়ার বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা দেশটিকে ব্যাপক সহিংসতার দিকে নিয়ে যেতে পারে; যা কেবল সিরিয়া নয়, পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।যদিও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় থাকা সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর লাভবান হয়েছে ইসরাইল। আসাদের বড় সমর্থক দেশ ইরানের প্রভাব কমে যাওয়ায় ঐ অঞ্চলে জোর সামরিক তত্পরতা শুরু করেছে ইসরাইল। গোলান বাফার জোন ‘সাময়িকভাবে’ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পাশাপাশি সিরিয়া জুড়ে বিমান হামলাও চালিয়েছে তারা। রাসায়নিক ও সামরিক অস্ত্রাগার ধ্বংস করে দিয়েছে। এমনকি নৌঘাঁটিও ইসরাইলি ধ্বংসের হাত থেকে বাদ যায়নি। আসাদের পতনের পর থেকেই ইসরাইল সিরিয়ায় বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে।সিরিয়ায় নিরাপত্তার চেয়ে অনিরাপত্তাই বেশি এখন। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশটি এখন রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সিরিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে জিহাদি গ্রুপ ইসলামিক স্টেট (আইএস) পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে এবং সিরিয়া জুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ হারানো, বিভিন্ন গ্রুপের সংঘাতে সিরিয়া এখন চরমপন্থিদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সুযোগ নিচ্ছে স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনী, আইএসের সহযোগী এবং অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠন। এসব সংগঠন কেবল নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলাই করছে না, গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ারও চেষ্টা করছে। এই চরমপন্থার বৃদ্ধি কেবল সিরিয়া নয়, প্রতিবেশী ইরাক ও জর্ডানসহ পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ সংগঠনগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে।বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তা চরমপন্থি আদর্শের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠবে। কারণ ক্ষমতাসীন হায়াত তাহরির আল-শামস (এইচটিএস) মূলত আল কায়েদার একটি সহযোগী সংগঠন। এই সংগঠনটি এখন ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলোর ওপর নিপীড়ন চালাতে পারে। এর ফলে সংঘাতও বাড়বে।