সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় সরকারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা তথ্যটি সঠিক নয়

 প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৫:২৫ অপরাহ্ন   |   জাতীয়

সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় সরকারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা তথ্যটি সঠিক নয়



ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে বাংলা সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় সরকারি, দাপ্তরিক বা রাষ্ট্রভাষা বলে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচার হয়ে আসা তথ্যটি সঠিক নয়।ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার জানায়, ২০০২ সালের পর থেকে প্রায় প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষা এবং সিয়েরা লিওনকে জড়িয়ে একটি তথ্য সামনে আসে। দাবি করা হয়ে থাকে, সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা বা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বা সরকারি ভাষা বা দাপ্তরিক ভাষা বাংলা। এই দাবি এতটাই জোরালো যে মূলধারার দেশ বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিভিন্ন মাধ্যমের ওয়েবসাইট, স্কুলের পাঠ্যবই, এমনকি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বা বিসিএসের প্রশ্নপত্রেও এই দাবিটি প্রচার হয়ে আসতে দেখেছে রিউমার স্ক্যানার টিম।ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থাটি জানায়, দাবিটির ব্যাপকতা বিবেচনায় রিউমর স্ক্যানার টিম দীর্ঘদিন বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছে। বিশ্লেষণ করা হয়েছে দেশি বিদেশি অর্ধশতাধিক গবেষণা প্রতিবেদন। খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত দাবির সূত্র।বাংলাদেশ এবং সিয়েরা লিওনের সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সাথে এ বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। অনুসন্ধানের শুরুটা ছিল দাবিটির মূল সূত্রপাত খোঁজার মধ্য দিয়ে।রিউমার স্ক্যানার টিমের দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলা সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় সরকারি, দাপ্তরিক বা রাষ্ট্রভাষা নয়; বরং দেশটির একমাত্র সরকারি ভাষা ইংরেজি। সিয়েরা লিওনে ক্রিও, লিম্বা, মেন্দে, এবং তেমনেসহ আরও কয়েকটি ভাষা প্রচলিত রয়েছে, যার মধ্যে ক্রিও সর্বজনীন ভাষা হিসেবে প্রচলিত।সিয়েরা লিওনের শিশুরা সাধারণত তাদের মাতাপিতার জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, প্রতিবেশীর ভাষা, ক্রিও, এবং ইংরেজি-এই চারটি ভিন্ন ভাষা শিখে বড় হয়।ফ্যাক্টচেক টিম জানায়, বিভিন্ন সূত্র থেকে পরিষ্কার যে, সিয়েরা লিওন একটি বহুভাষী দেশ। দেশটির একমাত্র আনুষ্ঠানিক বা সরকারি ভাষা ইংরেজি, কিন্তু ইংরেজির নিয়মিত ব্যবহার মূলত শিক্ষিত অল্পসংখ্যকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই দেশের ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্রিও, ইংরেজি, মেন্দে, তেমনে প্রভৃতি ভাষার ব্যাপক চর্চা লক্ষ্য করা যায়।


অন্যদিকে, সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষার ব্যবহার বা প্রচলন সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোতে পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধান চলাকালীন ফ্যাক্ট চেক টিম দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত সিয়েরা লিওনের দূতাবাসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় নিযুক্ত সিয়েরা লিওনের রাষ্ট্রদূতের দেওয়া একটি বক্তব্য খুঁজে পায়। বক্তব্যের শেষাংশে রাষ্ট্রদূত ক্যাথস জিবাও মাতাই বলেন, সিয়েরা লিওনের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রয়াত আহমেদ তেজান কাব্বা ২০০২ সালে বাংলা ভাষাকে সিয়েরা লিওনের একটি সম্মানসূচক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ২০০২ সালে সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে, দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বাহ বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে একটি ঘোষণা করেন। তবে ঘোষণাটি নিয়ে বিভিন্ন সূত্রের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।ফ্যাক্টচেক টিম জানায়, ভাষা নিয়ে কাজ করার অলাভজনক সংস্থা ট্রান্সলেটরস উইথাউট বর্ডার্স এর ওয়েবসাইটে সিয়েরা লিওনের ভাষা সম্পর্কে একটি নিবন্ধ পাওয়া যায়। ২০০৪ সালের জনশুমারি অনুসারে তৈরি নিবন্ধটি থেকে জানা যায়, দেশটিতে ১৮টি প্রধান ভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে ক্রিও প্রধান ভাষা। প্রায় ৯৭% জনগণ ক্রিও বুঝতে ও বলতে পারে। মেন্দে ও তেমনে হচ্ছে অন্য দুই প্রধান ভাষা। তবে ইংরেজি দেশটির সরকারি ভাষা হিসেবে শিক্ষা, সরকারি প্রশাসন এবং গণমাধ্যমে ব্যবহৃত হয়।অধিকতর অনুসন্ধানে যা জানা যায় যে, সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি বা সমজাতীয় দাবিগুলোর বিষয়ে জানতে গেল বছরের (২০২৩) মার্চে পশ্চিম আফ্রিকা ভিত্তিক ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান দুবাওয়ার সাথে যোগাযোগ করেছিল রিউমার স্ক্যানার। প্রতিষ্ঠানটির ফ্যাক্ট-চেকার ফাইয়া জুনিয়র মোসের রিউমার স্ক্যানারকে বলেন, সিয়েরা লিওনে ইংরেজি হচ্ছে একমাত্র সরকারি ভাষা। যদিও দেশটিতে বিভিন্ন ভাষার প্রচলন রয়েছে, তবে সেগুলো সরকারি মর্যাদা পায়নি। বাংলা ভাষা এবং সিয়েরা লিওন সম্পর্কে বাংলাদেশে প্রচলিত দাবিগুলো শুনে তিনি বিস্মিত হন, কারণ সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষার কোনো প্রচলন তিনি দেখেননি।ফ্যাক্ট চেক টিম জানায়, সিয়েরা লিওনের একাধিক সূত্র অনুযায়ী এটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, দেশটির প্রয়াত সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদ তেজন কাব্বাহ ২০০২ সালে সম্মানজনক মর্যাদা প্রদানে বাংলাকে দেশটির ভাষার তালিকায় বিবেচনা কিংবা অন্তর্ভুক্ত করার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তবে সিয়েরা লিওনে বাংলা দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কখনোই প্রচলিত ছিলনা।রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে,বাংলা সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় সরকারি, দাপ্তরিক বা রাষ্ট্রভাষা দাবিতে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচার হয়ে আসা তথ্যটি সঠিক নয়।পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওন। প্রায় ৭১,৭৪০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দেশটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বেশ বৈচিত্র্যময়। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করা দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ১৮টি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো সিয়েরা লিওনের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ দেশটির শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয়। বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশ সিয়েরা লিওনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেয়। ২০০২ সালে দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমাদ তেজন কাব্বাহ গৃহযুদ্ধের ইতি টানেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের সূত্র ধরেই বাংলাদেশ ও সিয়েরা লিওনের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।


জাতীয় এর আরও খবর: