দেশ জুড়ে একই সময়ে ডেঙ্গু, করোনা ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ১০:১৬ পূর্বাহ্ন | জাতীয়

একই সময়ে ডেঙ্গু, করোনা ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। জ্বর এলেই আতঙ্কিত হয়ে উঠছেন মানুষ, ভাবছেন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া না করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বেশি দুশ্চিন্তায় আছেন ছোট্ট শিশুর অভিভাবকরা। নিজেদের নিরাপদ রাখতে তারা কেউ নজর দিচ্ছেন মশারির দিকে; কেউবা মশা নিধনে, আবার কেউ-বা মাস্ক ব্যবহারে। চিকিৎসকরা বলছেন, বয়স্ক ব্যক্তি, দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, শিশু, গর্ভবতী নারী এবং যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। ফলে এ সময়ে কারো জ্বর হলে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
তারা বলছেন, সারা দেশেই ব্যাপক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু। একই সঙ্গে করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়ায় এ রোগ নিয়েও আতঙ্ক বাড়ছে। অন্যদিকে মশাবাহিত আরেক রোগ চিকুনগুনিয়ায়ও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ-উপসর্গ অনেকটা ডেঙ্গুর মতো হওয়ায় আক্রান্ত হলেও রোগীরা বুঝতে পারছেন না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুর প্রাক-মৌসুম জরিপে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) আওতাধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীন গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে চালানো প্রাক-বর্ষা জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৮ হাজার ৫৪৪ জন। প্রাণ হারিয়েছে ৩৪ জন। বরিশালের বরগুনা হয়ে উঠেছে ডেঙ্গুর রেড জোন। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধে হাসপাতালগুলো মোটামুটি প্রস্তুত। আক্রান্তের মধ্যে ৫৮ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৪১ দশমিক ২ শতাংশ নারী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত বছরের তুলনায় এ বছর মৃতের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও আক্রান্ত অনেক বেশি। ফলে এ বছর পরিস্থিতি গত বারের চেয়ে নাজুক হতে পারে। তারা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর জুন থেকে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে মশার সংখ্যা বেড়ে যায়। বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করার শঙ্কা রয়েছে। এ বছর থেমে থেমে বৃষ্টির সঙ্গে ভ্যাপসা গরম ডেঙ্গু বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
চলতি বছর ডেঙ্গু রোগের বাহকের কীটতাত্ত্বিক জরিপের ফল প্রকাশ করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। জরিপের তথ্য ও ফলাফলে জানা যায়, দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। এই এলাকাগুলো ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। জরিপে সবচেয়ে বেশি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে ফুলের টব ও ট্রেতে জমে থাকা পানিতে। জরিপে পাওয়া মোট লার্ভার ২৭ শতাংশই বসবাস করে এসব পানিতে। এছাড়া ২২ শতাংশ সিমেন্ট নির্মিত পানির ট্যাংকে, ২০ শতাংশ ফ্লোরে জমে থাকা পানিতে, ১৩ শতাংশ প্লাস্টিকের ড্রামে, ১১ শতাংশ লোহার পাইপে, ১০ শতাংশ প্লাস্টিকের পাত্রে এডিসের লার্ভা পেয়েছেন গবেষকেরা।
ডেঙ্গুর ভয়াবহতার বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, জ্বরে আক্রান্ত রোগীর এক পরীক্ষাতেই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা শনাক্ত করা সম্ভব হয়। আমরা গত বছর জিকা ভাইরাস পজিটিভ রোগী পেলেও এবার পাইনি। তবে গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এবার ৪৫ শতাংশ জ্বরের রোগীর চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে।চিকিৎসকরা বলছেন, এই তিন রোগের ক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ একই রকম মনে হলেও ডেঙ্গুর সঙ্গে করোনা ও চিকুনগুনিয়ার লক্ষণের পাঁচটি পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেন চিকিৎসকরা। এগুলো হলো—জ্বর: সাধারণত জ্বরের মধ্য দিয়েই ডেঙ্গু রোগীর প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পায়। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে সাধারণত চার থেকে পাঁচ দিন জ্বর থাকে। জ্বরের মাত্রা থাকে ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আর করোনার ক্ষেত্রে সাধারণত দুই থেকে সাত দিন অল্প মাত্রার (১০০ থেকে ১০১ ডিগ্রি ফা.) জ্বর থাকে। চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে অল্প থেকে বেশি মাত্রার জ্বর থাকতে পারে দুই থেকে চার দিন।
ব্যথা: ডেঙ্গুর আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণত মাথায়, চোখের পেছনে, মাংশপেশী, শিরদাঁড়ায় তীব্র ব্যথা হয়। করোনার ক্ষেত্রে মাথা ও মাংশপেশীতে অল্প থেকে মাঝারী আর চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে তীব্র ব্যথা হয়।
র্যাশ ও রক্তক্ষরণ: ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের র্যাশ উঠতে পারে। পাশাপাশি কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে হতে পারে রক্তক্ষরণ। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে অসুস্থতার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে র্যাশ উঠতে শুরু হয়। আর সাত দিনের মধ্যে কমে যায়। করোনার ক্ষেত্রে এই লক্ষণ থাকে না।
বমি ও পাতলা পায়খানা:এই লক্ষণ ডেঙ্গু আক্রান্তের ক্ষেত্রে অন্যতম। করোনা আক্রান্ত রোগীরও বমি বা পাতলা পায়খানা হতে পারে। তবে চিকুনগুনিয়ায় সাধারণত এ লক্ষণ দেখা যায় না।
রক্তচাপ কমে যাওয়া: ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রায় ৫০ ভাগ রোগীর রক্তচাপ কমে যায় এবং অল্পসংখ্যক রোগীর কিডনি, ব্রেইন, হার্ট বিকল হয়ে যেতে পারে। করোনায় আক্রান্ত রোগীর সাধারণত রক্তচাপ কমে না। কিন্তু ফুসফুস বিকল হয়ে যেতে পারে। তবে চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে রক্তচাপ কমে না, অর্গান বিকল হয় না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু ও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করে করলেও চিকুনগুনিয়া নিয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। ফলে এই রোগে আক্রান্তের সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা চিকুনগুনিয়া রোগের বাহক। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসটি টোগা ভাইরাস গোত্রের। মশাবাহিত হওয়ার কারণে একে আরবো ভাইরাসও বলে। দেশে ২০১৭ সালে ঢাকাসহ কয়েকটি জায়গায় চিকুনগুনিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তখন রিপোর্টিং সিস্টেম না থাকায় কত লোক আক্রান্ত হয়েছিল তার সঠিক কোনো তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সে সময় অন্তত ১ লাখ মানুষের চিকুনগুনিয়া হয়েছিল।
চলতি বছর এ পর্যন্ত মোট ৪৭৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৫২ হাজার ১৮ জনের। করোনায় ২০২৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে করোনায় এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৫১৮ জন।
করোনা পরিস্থিতি সামলাতে টিকা ও হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর বলেন, দেশে মাঝে দুই বছর করোনা না থাকায় আমাদের কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত ছিল। এখন পুরোদমে চালু আছে। ১৭ লাখ করোনা টিকা বিভিন্ন টিকাকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে করোনা শনাক্তকরণ কিট পৌঁছানো হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, দেশে প্রতি বছরই ডেঙ্গু সংক্রমণ হওয়ায় এ বিষয়টি সম্পর্কে জনগণ ও চিকিৎসকরা জানেন। আইইডিসিআরের সাবেক এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কিছু বাড়লেও এটা মারাত্মক হবে না বলে মনে করেন তিনি। তবে আগের ধারাতেই সব হলেও ডেঙ্গু সামলানো কঠিন হবে বলেও জানান।