শৈশব প্রেমঃ তাল বন্ধু
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারী ২০২১, ১১:১৬ পূর্বাহ্ন | লাইফস্টাইল

আনোয়ারা খানম :
সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা হয়তো ভাবছেন,তাল গাছ তো আমাদের সবার চেনা। তবে তাল নিয়ে ম্যাডাম আজ কী প্যঁচাল পাড়বেন?তা ঠিক ভাবছেন বন্ধুরা, তবে আমার প্রসঙ্গটি একটু ভিন্ন।
শিশুকালে আমার মত আপনারা সকলেই নিশ্চই ঝুমুর তালে এ ছড়াটি তালে তালে পড়েছেন-
* ঐ দেখা যায় তাল গাছ ঐ আমাদের গাঁ
- - - ----------------------- কানা বগীর ছাঁ
----------------------------পান্তা আমি খাই না
পুঁটি মাছ পাই না।
আমার বয়স তখন সাত-আট বছর হবে।পাঠশালা থেকে ফিরে আমার" পুকুর বন্ধুর " মনোরম দৃশ্য প্রাণভরে অবলোকন করা ছিল আমার প্রাত্যহিক কাজ।আমাদের বাড়ির পশ্চিমের বিশাল পুকুর নাম ছিল বড় পুকুর।দিনের এক এক সমযে তার রূপ এক এক রকম হ'ত। সকাল দশটা নাগাদ গাড় সবুজ ঘন কচুরিপানায় হাজার হজার নীল হলুদ বাহারী ফুল ফুটতো।সকালের সোনালী নরম রোদ।শত বুচি বগ ছোট ছোট পানার ঢিপির ওপর বসে পুঁটি মাছ শিকার করতো। সে এক অপরূপ দৃশ্য!
আমার মা ঘাটে তালের খাইটায় বসে আপন মনে মাছ ধুচ্ছিলেন।আমি প্রানভরে পুকুর বন্ধুকে উপলব্ধি করছিলাম।
হঠাৎ দুইটা বগ ডানা ঝাঁপটাতে লাগলো,জাঁতি কলে তাদের পা আঁটকে গেছে।শিকারী ছেলেরা খুশিতে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে বক দু'টি ধরে পাঁড়ে এনে জবাই করলো।আমার খুব কান্না পেল! মাকে বললাম , এবার ওদের ছানারা তো না খাবার পাইয়ে মইরে যাবিনে!
মা আপন মনে তাঁর কাজ করে যাচ্ছেন।তখন পৌষ-অঘ্রাণ মাাস পানি খুব কাল।কী মনে হ'ল আমি পুকুরে গলা পানিতে কচুরিপানা বিলি কাইটে যাইয়ে,যতগুলো যাঁতি কল পাইলাম পানিতে ফেলাইয়ে দিলাম।আমি ঠান্ডায় কাঁপছি পানা ঠেলে উঠে আসতে পারছি না! হঠাৎ মার নজরে আসার সাথে সাথে, পুকুরে নাইমে, আমার ড্যানা ধরে উপরে তুলে, ঠাট্টাইয়ে চড় মারতে মারতে কইলেন "কপাল পুড়াতা পানিতে ডুইবে তো আজই মরতি"! দুইফেরে আব্বা বাড়ি আসলে মা সব তাঁকে জানালেন।আব্বা আমাকে কোলে নিয়ে আদর করে বুঝাইয়ে কইলেন , কত কল পাতা! তুমি কয়টা কল ফেলবে মা! দুষ্ট লোকদের মানা করলেও ওরা শুনবে না!!তুমি আর কখনও পুকুরে নামবে না,মা না দেখলে আজ তোমার কী অইতো কও?আমার তখনও ছানাদের কথা ভাইবে বুক পুঁড়ছিলো!!আব্বা মারে কইলেন, "শাহির মা, যা কর তা কর, আমার মাইয়ের দিক নজর রাইখো"।
বন্ধুরা সেই ছড়াটির কাঁনা বগীর ছাঁর পুঁটি মাছ খাওয়ার দৃশ্য টি মাথায় ক্লিক করেছিল!এ ভাবে মানুষ, শিকার করতে করতে এখন আর এলাকায় ওষুধ করার জন্যও একটি বুচি বগ খুঁজে পাওয়া যায় না! বড় হয়ে বিজ্ঞান পড়তে যেয়ে বুঝলাম ইকোসিস্টেম কী? মানুষ কীভাবে ইকোসিস্টেম ধংস করে পরিবেশ ধংস করছে!শিশুকালের সেইদৃশ্যের সাথে মিল খুঁজে পাইলাম।আমাদের পরিবেশ ধংসের জন্য আমরা দায়ী।যার পরিণতি আমরা হাঁড়েহাঁড়ে ভোগ কোরছি!!
বন্ধু রা এবার আসি তালগাছ প্রসঙ্গে। প্রথমেই সালাম জানাই আমার পূর্ব পুরুষদের, যাঁরা মনোরম করে আমার পিতৃভিটা রকমারি উদ্ভিদ দিয়ে সাজিয়ে ছিলেন।যার সুফল শিশুকাল থেকে আজও আমরা উপভোগ করছি।
আমাদের গ্রামে খুব কম বাড়িতে আমি দু'একটি তালগাছ দেখেছি,এমন কী এখনও সে রকম! কারন হিসাবে বলবো মানুষের অলসতা বা সচেতনতার অভাব। অথছ এ গাছটি খুব অল্প যায়গায় শুধু মাটিতে বীজ গেড়ে রাখলেই হয়।এ কথা ঠিক বার বছরের আগে তাল গাছে ফল ধরে না কিন্তু এ গাছ প্রায়১০০বছর বাঁচে,এর উপকারিতাও বহুবিধ।
আমাদের বাড়ির পশ্চিমে, পূর্ব উত্তর কোনে,দক্ষিণে বেশ সংখ্যক তালগাছ ছিল।দক্ষিণ পশ্চিম কোনে একটি গাছ ছিল সেটিতে শুধু জট হতো।মালেক চাচা (বার মাস আব্বা র সহযোগি)জটের মুখ কেটে হাড়ি পেতে রস নামাতেন।তাল রস,তালগুড় আমাদের প্রিয় খাবার ছিল।
এক দিন মলেক চাচা মাকে কইলেন,"আপনাদের বাড়ি এই জউটে গাছ থাকায় অনেক ফল ধরে।আমাগে এট্টা গাছ আছে তাতে কাইনে ফল এত কম হয়!" আমার মাথায় আবার বিষয়টি ক্লিক করলো।আমি বললাম," আপনি জউটে গাছ লাগান না কেনো?" তিনি বললেন," মারে তাল গাছে ফুল আসতে অনেক বছর লাগে,ততদিনে আমি মইরে ভূত হয়ে যাবানে!"কিন্তু কেন জউটে গাছ থাকলে, ফল বেশি হয় তার কোন উত্তর পাইনি। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উদ্ভিদ বিদ্যা পড়তে যেয়ে জানলাম তাল গাছ একটি একবীজপত্রী উদ্ভিদ। মেয়ে ফুল এবং পুরুষ ফুল ভিন্ন ভিন্ন গাছে হয়।কাছাকাছি পুরুষ গাছ থাকলে বাতাসে সহজে পরাগ রেনু মেয়ে ফুলের সংস্পর্শে আসতে পারে।পরাগায়ন অনেক বেশি সফল হয়,তাই ফল বেশি ধরে।
আবার স্যালুট আমার পূর্ব পুরুষদের তাঁদের একাডেমিক শিক্ষা ছিল না,কিন্তু প্রাকৃৃতিক জ্ঞান সমৃদ্ধ ছিলেন।
অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ আরও একটি বিষয় বলতে চাই,তাহ'লো একটি বাড়ির সব যায়গার মাটির গঠন শৈলী কিন্তু এক রকম নয়।তাই সব যায়গার গাছের ফলন ও স্বাদেও ভিন্নতা থাকে।আমাদের বাড়ির দক্ষিণের এবং পশ্চিমের তাল গাছের তাল খুব মিষ্টি,মোটেই তেঁতো নয়। কিন্তু পূব পাশের গাছের তাল খুব তেঁতো।আবার এও দেখেছি,খেজুরের রসও একই রকম বৈশিষ্ট্য বহণ করে
* তাল গাছের উপকারিতাঃ
১) আমার পূর্ব পুরুষের প্রায় তিনশত বছর পুরোনো ঘরটি , খুঁটি শাল কাঠের, পাইড় ও আড়া তাল কাঠের, আজও চকচকে এবং অক্ষত।
২) চৈত্র বৈশাখের দুপুরে তাল শ্বাস বাড়ির ছোট বড় সকলে তৃপ্তি ভরে খেতাম।কী তার স্বাদ! কী তার পুষ্টি! মনে হয় সে রিজার্ভ শক্তিতে আজও আল্লার রহমতে অসীম শক্তিতে চলতে পারছি।
৩) শ্রাবণ ভাদ্র মাসে তালের কলা পাতা ধাপড়া,বড়া,পরাঙ্গী ধানের আলো চালের তাল গুড়ের পাঁয়েশ,সে কী সুস্বাদু! ছোট মাইধেন,সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা কত মজা করে খেতাম! দুধ - তাল রান্নাও খুব মজা, আমরা সকলে মুড়ি দিযে নাস্তা করতাম।
বিভিন্ন সিজনে বিভিন্ন ফল ও তা দিয়ে তৈরি পিঠা খেয়ে সবার স্বাস্থ্য ভালো ও রোগমুক্ত থাকতো।
৪) কার্তিক মাসে তাল বীজের ফোঁপা আমাদের আর একটি প্রিয় খাবার ছিল। বিশেষ করে তাল ফোঁপার শুকনা ও রসাল মোরব্বা খুবই মজার ছিল! মা বানিয়ে গোপালগঞ্জ বড় কাকার জন্য পাঠাতেন।এটি তাঁর খুব প্রিয় খাবার ছিল।
৫)তাল গাছ ছিল শকুনের আবাস।তাছাড়া বড় বড় সাদা বক,বাদুড় তাল গাছে থাকতো।বাবুই পাখি তো তাল গাছ ছাড়া কোথাও বাসা বাঁধে না।
৫) একবার প্রচন্ড ঝড় আর বজ্রের বিকট শব্দে আমরা ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম! মা কইলেন, "ভয় নাই আমাদের তাল গাছে ঠাঁটা পড়েছে"! সকালে যাইয়ে দেখি বড় একটা তাল গাছের সব পাতা পুঁড়ে গেছে।মাঝামাঝি গাছটা ফেঁড়ে গেছে।
এখন বৈশ্বিক আবহাওয়া র পরিবর্তনে আমাদের দেশে প্রচুর বজ্রপাতে জান মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে! তালগাছ এ বিপদের হাত থেকে বাঁচতে পারে।কিন্তু কোথায় পাব তাল গাছ?
আসুন আমরা রাস্তার দুই ধারে,ক্ষেতের আইল, পুকুর পাড়,বাড়ির আঁনাচ কাঁনাচে পর্যাপ্ত তাল গাছ লাগাই।আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি কে আগামী প্রজন্মের জন্য "পরিবেশ বান্ধব " করে গড়ে তুলি।
যদি আমার "তাল বন্ধুর " উপলব্ধি সমৃদ্ধ গল্পটি আপনাদের মনে সাড়া জাগায়,তবে নিজেকে ধন্য মনে করবো।
ধৈর্য ধরে "তাল বন্ধুর" কথা শুনার জন্য আপনাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ।